Quantcast
Viewing all articles
Browse latest Browse all 358

মোমেনার সাক্ষী আবদুল কাদের মোল্লার দণ্ড ও বিচারের নীতি..অলিউল্লাহ নোমান

Image may be NSFW.
Clik here to view.
জামায়াতে ইসলামীর সহকারী মহাসচিব আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির দণ্ড কার্যকর হওয়ায় শাহবাগিদের নগ্ন উল্লাস প্রচারে ব্যস্ত ইন্ডিয়াপন্থী’ আওয়ামী-বাম মিডিয়াগুলো। এক তরফা প্রচারণায় শাহাদাতের পথযাত্রী আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে অভিযোগের ফিরিস্তি ও বয়ানও অব্যাহত আছে। আবদুল কাদের মোল্লার রুহের মাগফিরাত কামনায় দেশজুড়ে আয়োজিত গায়েবানা জানাজার হাজারও মানুষের উপস্থিতি তাদের চোখে পড়ে না। শুধু দেশজুড়ে নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেশে গায়েবানা জানাজা হয়েছে আবদুল কাদের মোল্লার জন্য। কাশ্মীর থেকে ফিলিস্তিন, তুরস্ক থেকে ইংল্যান্ড, আমেরিকা থেকে আফ্রিকা মুসলমানের আবাস রয়েছে এমন কোনো দেশ বাদ নেই আবদুল কাদের মোল্লার জন্য গায়েবানা জানাযা হয়নি।
আবদুল কাদের মোল্লার স্ত্রী-সন্তানরা ফরিদপুরে গ্রামের বাড়িতে পৌঁছার আগেই লাশ দাফন, পাড়া-প্রতিবেশীদের বাড়িতে ঢুকতে পুলিশের বাধা, লাশের মুখ দেখতে না দেয়ার মতো অমানবিক আচরণ করেছে পুলিশ। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে শেষ দেখায় দাফনের বিষয়ে বলে যাওয়া ইচ্ছাটুকু পূরণের সুযোগ দেয়া হয়নি। পারিবারিক ঘনিষ্ঠ একজন জানান, শেষ দেখায় তার অছিয়ত ছিল হজের সময়ে গায়ে জড়ানো এহরামের কাপড়টি দিয়ে কাফনের পোশাক লাগানো, বড় মেয়ের জামাইকে দিয়ে জানাজায় ইমামতি করানো এবং কবরে বড় মেয়ের জামাইসহ দুই ছেলেকে দিয়ে লাশ কবরে নামানো। এর কোনো সুযোগ না দিয়ে কড়া পুলিশ পাহারায় ভোরের আগেই রাতের আঁধারে দাফনের সব আয়োজন হয় সরকারি হেফাজতে। ফাঁসির পরও প্রাণহীন আবদুল কাদের মোল্লার দেহকে ভয় পেয়েছে সরকার। সেজন্যই হয়তো নিশ্চিদ্র নিরাপত্তায় রাতের আঁধারে এতসব আয়োজন। এমনকি স্থানীয় সাংবাদিকদেরও রাস্তায় আটকে রাখা হয় লাশ গ্রামের বাড়িতে না পৌঁছা পর্যন্ত।

আবদুল কাদের মোল্লার লাশ নিয়ে সরকারের এই অমানবিক আচরণ, গ্রামের বাড়িতে গভীর রাতেও জানাজায় অংশ নিতে বাধা, লাশের মুখ দেখতে সুযোগ না দেয়ার বিষয়েও কোনো মিডিয়ায় একটি শব্দ নেই। তাদের এক চোখ অন্ধ। দেশব্যাপী গায়েবানা জানাজায় হাজারও মানুষের ঢল তারা দেখেনি। তারা শুধু দেখছেন শাহবাগের উলঙ্গ নর্তন। কারণ তারা কথিত নিরপেক্ষ! ইসলাম এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে এক তরফা, নিজেদের পছন্দের সংবাদই হলো তাদের নিরপেক্ষতার মানদণ্ড। শুধু তাই নয়, আবদুল কাদের মোল্লার বিচারে অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তরও পাওয়া যায়নি। এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পাওয়ার আগেই বিহারী কসাই কাদেরের দায় বহন করে ফাঁসির মঞ্চে প্রাণ উত্সর্গের মাধ্যমে সরকারি হেফাজতে আখেরাতের পথে রওয়ানা দিতে হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধে মানবতা বিরোধী অপরাধ হয়েছে তাতে কারও সন্দেহ এবং দ্বিমত নেই। সেই মানবতা বিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের বিচার করতে হবে তাতেও কারও আপত্তি থাকার কথা নয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বে যারা বিশ্বাস করেন তারা সবাই সব মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচার চায়। মুক্তিযুদ্ধের পর চিহ্নিত মানবতা বিরোধীদের ছেড়ে দেয়া হয় রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে। ১৯৫ জন পাকিস্তানি সামরিক সদস্যকে মানবতা বিরোধী অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। স্বাধীনতার পরপর রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে তারা মুক্তি পেয়ে নিরাপদে পাকিস্তান প্রত্যাবর্তন করেন। ৪২ বছর পর আবদুল কাদের মোল্লা বিতর্কিত বিচারে, বিতর্কিত সাক্ষীর ভিত্তিতে, রাজনৈতিক পরিচয়ে পরিচিত বিচারকদের রায়ে মানবতা বিরোধী অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত হলেন। ইনসাফ ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিচার ছিল জনদাবি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকেও বিচারের মানদণ্ড নিয়ে প্রতিটি ধাপে প্রশ্ন রয়েছে। এছাড়া ট্রাইব্যুনাল এবং তদন্তকারী সংস্থার কার্যক্রমেও বার বার বিতর্কিত এবং প্রশ্নবিদ্ধ করেছে বিচারককে।
এতদিন শুনে আসছিলাম বিচারের নীতি হলো সন্দেহাতীত প্রমাণ ছাড়া কাউকে ফাঁসির দণ্ড দেয়া যায় না। আর বেনিফিট অব ডাউট হচ্ছে আসামি পক্ষে। এছাড়া আবেগ, অনুরাগ, বিরাগের ঊর্ধ্বে উঠে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠাই হচ্ছে বিচারের চিরন্তন নীতি। আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির দণ্ডের আগে কয়েকটি প্রশ্নের সন্দেহাতীত উত্তর পাওয়া যায়নি। নানা বিষয়ে সন্দেহ সংশয় রয়েছে প্রতিটি ধাপে। রায় পাঠ করলে মনে হয়, সাক্ষীদের বক্তব্য আইনের বিচার বিশ্লেষণে পরীক্ষা-নিরীক্ষার চেয়ে মুক্তিযুদ্ধের আবেগ দ্বারা বেশি তাড়িত হয়েছেন বিচারকরা।
আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ৬টি ঘটনার অভিযোগের মধ্যে একটিতে ট্রাইব্যুনাল বেকসুর খালাস দেয়। চারটিতে বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ড দিয়ে একটি অভিযোগের জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল। চারটি অভিযোগে আবদুল কাদের মোল্লার সরাসরি সম্পৃক্ততা ট্রাইব্যুনালেও সাক্ষ্য প্রমাণে সন্দেহাতীত প্রমাণিত হয়নি। একটি অভিযোগের বিতর্কিত সাক্ষ্যে যাবজ্জীবন দেয়া হয়। সেই রায়ের বিরুদ্ধে শুরু হওয়া ইসলাম বিদ্বেষী নাস্তিকদের নেতৃত্বে শাহবাগ আন্দোলনের জের ধরে সরকার আইন পরিবর্তন করল। রায়ের বিরুদ্ধে সরকার পক্ষ আপিলের সুযোগ নিল আইন পরিবর্তনের মাধ্যমে। পার্লামেন্টে নিজেদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকলে আইন পরিবর্তনের সুযোগ ছিল না। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে যাবজ্জীবন থেকে রায় ফাঁসিতে উন্নীত করার লক্ষ্য নিয়েই আইনের সংশোধনী আনা হয়। বিচার চলাকালীন আইন পরিবর্তনের মাধ্যমে যাবজ্জীবন থেকে শাস্তি বাড়িয়ে ফাঁসির দণ্ড বিচারের এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপিত হলো।
আপিলে ৪:১ বিভাজনে রায়। চার বিচারপতি যে অভিযোগে ফাঁসি দিতে একমত হয়েছেন সেই অভিযোগের বিষয়ে এক বিচারপতি ভিন্নমত দিলেন। সাক্ষীর বিতর্কিত বক্তব্য নিয়েও ভিন্নমত পোষণকারী বিচারপতির লেখা রায়ে অভিমতও দিলেন। এতে কিন্তু প্রমাণিত হলো চারজন ফাঁসির পক্ষে অবস্থান নিলেও সাক্ষীর বক্তব্য সন্দেহাতীত নয়। যে বিষয়টি নিয়ে শুরু থেকেই বিতর্ক রয়েছে তার কোনো বিচারিক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সন্দেহের ঊর্ধ্বে ওঠা গেল না। বিতর্কিত সাক্ষীর বিষয়ে ভিন্ন মত প্রদানকারী বিচারপতির বিশ্লেষণ এবং পাঁচটি অভিযোগ থেকে বেকসুর খালাস সেটাই প্রমাণিত হয়। বিতর্কিত সাক্ষীর কারণে ভিন্নমত পোষণকারী বিচারপতি ট্রাইব্যুনালের রায় যাবজ্জীবন বহাল রাখেন। সেই মোমেনার সাক্ষীর ভিত্তিতেই আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি দেয় চার বিচারপতি। শুধু তাই নয়, যে দু’জন বিচারপতির বিরুদ্ধে শুরুতেই আবদুল কাদের মোল্লা ন্যায় বিচার না পাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে অনাস্থা জানিয়েছিলেন তারাই রায় লিখেছেন। বাকি দু’জন শুধু একজনের লেখা রায়ের সঙ্গে একমত পোষণ করে স্বাক্ষর করেন।
মিরপুরের হযরত আলী লস্করের পরিবারের হত্যাকাণ্ড এবং সেই পরিবারের মহিলাদের ধর্ষণের জড়িত থাকার অভিযোগের ভিত্তিতে মূলত ফাঁসি হয়েছে। সেই অভিযোগের মূল সাক্ষী ছিল একজন। হযরত আলী লস্করের কন্যা মোমেনা বেগম। ঘটনা সম্পর্কে মোমেনা বেগমের তিনটি পৃথক বক্তব্য রয়েছে। একটি হলো মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সংগ্রহে, একটি মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার সংগ্রহে এবং একটি বক্তব্য হলো ট্রাইব্যুনালের কাছে।
প্রথমে দেখা যাক মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সংগ্রহে মিরপুরের জল্লাদ খানায় সংরক্ষিত বক্তব্যে মোমেনা বেগম কী বলেছিলেন। তখন কিন্তু এই ঘটনা নিয়ে কোনো মামলা-মোকদ্দমা নেই। কোনো থানায় একটি জিডিও নেই। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের কাছে বক্তব্য প্রদানের আগে মোমেনা বেগমকে কেউ ভয়-ভীতি দেখিয়েছিলেন এমন অভিযোগ করার সুযাগ নেই। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের কাছে ২০০৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর তিনি এই বক্তব্য দিয়েছেন। তখন বর্তমান সরকারের পূর্বসূরি জরুরি আইনের সরকার ক্ষমতায়। জরুরি আইনের সরকারের তত্ত্বাবধানেই সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম গঠিত হয় যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে। তখন তারা খুবই সোচ্চার ছিলেন। সুতরাং মোমেনা বেগম মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর কর্তৃপক্ষের কাছে নির্বিঘ্নে, নিঃসংকোচে বক্তব্য দিয়েছেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বলার সুযোগ নেই বৈরী সরকার থাকায় সঠিক বক্তব্য তখন দিতে পারেননি।
সেই বক্তব্যে মোমেনা বেগম জানিয়েছেন ঘটনার সময় তিনি বাড়িতে ছিলেন না। শ্বশুরবাড়ি চলে যাওয়ার দু’দিন পর তার পিতা-মাতাসহ পরিবারের অন্যরা হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। বাড়িতে না থাকায় তার প্রাণে বাঁচারও সুযোগ হয়। কয়েক দিন পর ঘটনা জানতে পেরে খোঁজ নিতে এসে দেখেন কেউ নেই। কাউকে না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরে যান।
এবার দেখা যাক তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে কী বলেছেন। হযরত আলী লস্করের পরিবারকে হত্যার অভিযোগে আবদুল কাদের মোল্লাকে জড়িয়ে মামলা হয় বর্তমান সরকারের আমলে। এই মামলা তদন্ত করেন বর্তমান সরকারের নিয়োজিত তদন্তকারী কর্মকর্তা। তখন আবদুল কাদের মোল্লা কারাগারে। সুতরাং তখনও মোমেনা বেগম নির্বিঘ্নেই তার পরিবার হত্যাকাণ্ডের বিবরণ তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে বলার সুযোগ পেয়েছেন। তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে মোমেনা বেগমের বক্তব্য হচ্ছে—তার বাবা-মাসহ পরিবারকে হত্যা করেছে বিহারিদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছেও হযরত আলী লস্করের মেয়ে আবদুল কাদের মোল্লাকে জড়িয়ে কোনো বক্তব্য দেননি।
তৃতীয় বক্তব্যটি হচ্ছে ট্রাইব্যুনালের কাছে। ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেয়ার সময় বোরকার নেকাবে মুখ আবৃত মোমেনা বেগমকে হাজির করা হয়। তার সাক্ষ্য নেয়া হয় ক্যামেরা ট্রায়ালে। অর্থাত্ প্রসিকিউশন এবং আসামিপক্ষের আইনজীবী ও বিচারক ছাড়া অন্য কেউ সেই কামরায় উপস্থিত ছিলেন না। ক্যামেরা ট্রায়ালের নিয়ম অনুযায়ী সেখানে প্রদত্ত্ব বক্তব্য বাইরে প্রকাশেরও কোনো সুযোগ নেই। পরবর্তীতে রায় প্রকাশের সময় দেখা যায় মোমেনা বেগম তার বাবা-মাসহ পরিবারের সদস্যদের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আবদুল কাদের মোল্লাকে জড়িয়ে ট্রাইব্যুনালে বক্তব্য দিয়েছিলেন। তিনি ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন এবং নিজেও ধর্ষণের শিকার বলে দাবি করেন ট্রাইব্যুনালে।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের নিয়ন্ত্রিত মিরপুরের জল্লাদখানায় সংরক্ষিত বক্তব্যটির অনুলিপিও আবদুল কাদের মোল্লার পক্ষ থেকে আইনজীবীরা ট্রাইব্যুনালে জমা দেন। তখন নথিভুক্ত করে বলা হয় রায় প্রদানের সময় এ বিষয়ে বিবেচনা করা হবে।
প্রশ্ন হচ্ছে ঘটনা একটি। সাক্ষ্য মাত্র একজন। একই সাক্ষীর বক্তব্য ৩ জায়গায় ৩ রকমের। কোনটা সত্য? মুক্তিযুদ্ধের প্রতি যাদের অবিচল আস্থা, তারাই গড়ে তুলেছেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। তাদের কাছে মোমেনা বেগমের প্রদত্ব বক্তব্যটিতে ছলচাতুরির আশ্রয় নেয়ার কোনো প্রশ্ন থাকতে পারে না। তেমনি তদন্তকারী কর্মকর্তাও সরকারি নিয়ন্ত্রণে। সাক্ষীদের ট্রেনিংয়ের জন্য তদন্ত সংস্থার নিয়ন্ত্রণে সেফহোম ছিল। সেখানে সাক্ষীদের এনে দিনের পর দিন রেখে কী বলতে হবে—সেটার ট্রেনিং দেয়া হতো। পুলিশ হেফাজতে সরকারি খরচে থাকা-খাওয়া। ঢাকার গোলাপবাগের সেই সেফহোমের কাহিনী দালিলিক প্রমাণসহ পত্রিকায় প্রকাশ করেছি আমি নিজে। কেউ কোনো প্রতিবাদ করেননি। তারপরও কি তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে আবদুল কাদের মোল্লার নাম বলতে মোমেনা বেগমের মনে ভয় ছিল!
ট্রাইব্যুনালে প্রদত্ব মোমেনা বেগমের বক্তব্যটি সত্য হিসেবে ধরে নিয়ে মৃত্যুদণ্ড দিতে পারলে একই মোমেনা বেগমের বাকি দুটি বক্তব্য কি তাহলে অসত্য ছিল? যদি অসত্য হয়ে থাকে, তবে সেটা কেন এর গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা থাকার দরকার ছিল? এই ব্যাখ্যা থাকলে আমাদের মতো অনভিজ্ঞ, নির্বোধ মানুষগুলো হয়তো জানতে পারতাম মোমেনা বেগম মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর কর্তৃপক্ষ এবং তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে যে বক্তব্যটি দিয়েছিলেন—সেটা সুনির্দিষ্ট একটি কারণে সত্যতা হারিয়েছে। সত্যতার মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হয়েছে মোমেনা বেগমের পক্ষ থেকে ট্রাইব্যুনালে প্রদত্ব বক্তব্যটি।
পত্রিকায় দেখা গেছে, রিভিউ আবেদনের বিষয়ে সুপারসনিক গতিতে শুনানি চলাকালে আবদুল কাদের মোল্লার আইনজীবী বিষয়টি উত্থাপন করেছিলেন। তার জবাবে দুজন বিচারপতি শুধু বললেন, আমরা বিশ্বাস করেছি বলেই ফাঁসি দিয়েছি। যে দুজন এ কথা বলেছেন, তাদের প্রতিই আবদুল কাদের মোল্লা ন্যায়বিচার না পাওয়ার আশঙ্কা জানিয়ে অনাস্থা দিয়েছিলেন। কেন শুধু একটি বক্তব্য বিশ্বাস করলেন এবং বাকি দুটি বক্তব্য বিশ্বাস করলেন না—সেটার কোনো বিস্তারিত আমরা দেখতে পেলাম না।
এদিকে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর আবদুল কাদের মোল্লার পরিবারের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে দাবি জানানো হয় ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত হওয়া মোমেনা বেগম এবং হযরত আলী লস্করের মেয়ে মোমেনা এক নন। বোরকা ও নেকাবে মুখ আবৃত ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত হওয়া মোমেনাকে নিয়ে উত্থাপিত এ প্রশ্নেরও কোনো উত্তর নেই। সরকার, প্রসিকিউশন সবাই নীরব।
আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরও হয়েছে সুপারসনিক গতিতে। এক্ষেত্রে জেল কোডের কোনো কিছুই অনুসরণ করা হয়নি। জেল কোড অনুযায়ী মৃত্যু পরোয়ানা জারির পর রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাওয়ার জন্য ৭ দিন সময় থাকে। সে সময়টি পর্যন্তও দেয়া হয়নি আবদুল কাদের মোল্লাকে। জেল কোডের আরেকটি বিধান হলো মৃত্যু পরোয়ানা জারির ২১ দিন আগে নয় এবং ২৮ দিন পর নয়—এমন সময়ের মধ্যে দণ্ড কার্যকর হবে। আবদুল কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে সেটাও মানা হয়নি।
বাংলাদেশের প্রচলিত বিচার ব্যবস্থায় দায়রা আদালতে মৃত্যুদণ্ড হলে হাইকোর্ট বিভাগে পর্যালোচনা এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া দণ্ড কার্যকরের কোনো সুযোগ নেই। হাইকোর্ট বিভাগে দণ্ড বহাল থাকলে আপিল বিভাগে যাওয়ার সুযোগ থাকে। আপিল বিভাগে বহাল থাকলে রায় প্রকাশের ৩০ দিনের মধ্যে রিভিউ আবেদন দায়েরের সুযোগ পাওয়া যায়। রিভিউ আবেদনের নিষ্পত্তির পর মৃত্যু পরোয়ানা জারি হয়। এতগুলো স্তর অতিক্রমের উদ্দেশ্য হলো চূড়ান্ত দণ্ড কার্যকরের আগে বার বার পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সন্দেহের ঊর্ধ্বে ওঠা। আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির দণ্ড হয়েছে আপিল বিভাগে। আর কোনো উচ্চতর জায়গা নেই সেটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা প্রতিকার চাওয়ার। শেষ পর্যন্ত রিভিউ করারও সুযোগ হয়নি।
আইনে প্রাপ্য সুযোগ থেকে আবদুল কাদের মোল্লা বঞ্চিত হলেও মানুষের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হননি। ফাঁসির মঞ্চে প্রাণ উত্সর্গকারী আবদুল কাদের মোল্লাকে রাতের আঁধারে সরকারি নিয়ন্ত্রণে দাফন করা হলেও তার গ্রামের মানুষ ঠিকই দিনের বেলায় জুমার নামাজের পর গায়েবানা জানাজার মাধ্যমে তার মাগফিরাতের ফরিয়াদ জানিয়েছেন আল্লাহর দরবারে। শুধু তার গ্রাম নয়, বাংলাদেশের প্রতিটি উপজেলা থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পর্যন্ত গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে আবদুল কাদের মোল্লার জন্য। নিজ দেশের মানচিত্রের সীমানা ছাড়িয়ে বাংলাদেশের বাইরেও আবদুল কাদের মোল্লার জন্য বিশ্বের দেশে দেশে হাজারো মুসলমান গায়েবানা জানাজা আদায় করেছেন। সরকার বঞ্চিত করার চেষ্টা করলেও দুনিয়াজুড়ে মুসলমানের ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা নিয়ে আবদুল কাদের মোল্লা আখেরাতের পথযাত্রী হয়েছেন। এটাই মোমেনের জীবনে সবচেয়ে বড় প্রাপ্য।

লেখক : দৈনিক আমার দেশ-এর বিশেষ প্রতিনিধি; বর্তমানে যুক্তরাজ্যে নির্বাসিত

Viewing all articles
Browse latest Browse all 358

Trending Articles