Quantcast
Channel: Truth Revealer
Viewing all articles
Browse latest Browse all 358

সরেজমিন : কুতুবদিয়া ট্র্যাজেডি : গুলি করে তিন জনকে হত্যাকারী রাজিব চাকমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ ওসি জহিরুল : ইউএনওর নির্দেশে গুলি চালানো হয়

$
0
0
‘আমার রাজিব (পুলিশ কনস্টেবল রাজিব চাকমা) গুলি না করলে এই চেয়ারে বসা সম্ভব হতো না! এমনকি এখন জনতার লাশ দেখতে পেয়েছি, তখন আমার পুলিশ ভাইদের লাশ দেখতে হতো!’
গত ২৯ অক্টোবর কক্সবাজারের কুতুবদিয়ায় তিন লোককে গুলি করে হত্যাকারী পুলিশ সদস্যের প্রশংসা করে এমন বক্তব্য দিলেন কুতুবদিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জহিরুল ইসলাম খান। ওই ঘটনায় পুলিশের গুলিতে ৩ জামায়াত সমর্থকের মৃত্যু হয়েছে। গুলিবিদ্ধ ব্যক্তিসহ আহত হয়েছেন আরও অন্তত ২৫ সাধারণ মানুষ। গত শনিবার কুতুবদিয়া থানায় বসে কয়েকজন সাংবাদিকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল ওসি জহিরুল ইসলাম খানের। তিনি বলেন, ‘রাজিব একাই ৫০ রাউন্ড গুলি করে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে।’
বেপরোয়া গুলি বর্ষণকারী কনস্টেবল রাজিবের মতো কুতুবদিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছেও ‘কৃতজ্ঞ’ ওসি জহিরুল। তার মতে, ‘উনার’ নির্দেশ পেয়েই এত গুলি করা সম্ভব হয়েছে!

২৯ অক্টোবরের জামায়াতের ধুরুং বাজারের সমাবেশকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সহিংতা নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করতে কক্সবাজার থেকে কয়েকজন সাংবাদিক শনিবার কুতুবদিয়া যান। তারা ওসির সঙ্গে সাক্ষাতের আগে স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শী এবং ভুক্তভোগী মানুষের সঙ্গে কথা বলেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা সাংবাদিকদের জানান, কুতুবদিয়া থানার ‘রাজিব চাকমা’ নামে এক সদস্য একাই নির্বিচারে গুলি করেছেন। বিশেষ করে ওই রাজিব খুবই কাছ থেকে নিহত তিনজনের মধ্যে আবু বক্কর ছিদ্দিককে গুলি করে হত্যা করেন বলেও প্রত্যক্ষদর্শীরা নিশ্চিত করেছেন।
সাধারণ মানুষের মতে, কুতুবদিয়ার তিন হত্যার খলনায়ক একাই রাজিব! আর ওসি জহিরুল মনে করেন, রাজিব না হলে চারজনের মতো পুলিশ মারা যেত, এমনকি তাদের লাশও খুঁজে পাওয়া যেত না!
ঘটনা যেভাবে শুরু : কুতুবদিয়ার একাধিক স্থানীয় ব্যবসায়ী, জামায়াত নেতা, ধুরুং বাজার কমিটির কর্মকর্তাসহ একাধিক প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৮ দলের ডাকা ৬০ ঘণ্টার হরতালের শেষ দিন ২৯ অক্টোবর কুতুবদিয়া উপজেলা জামায়াত ও ছাত্রশিবির কর্মীরা কুতুবদিয়ার অজপাড়া গাঁ ধুরুং বাজারে সমাবেশের আয়োজন করেন। ওই সমাবেশের জন্য বাজারের মধ্যখানে মাইকও টানানো হয়। কিন্তু বিনা কারণে পুলিশ মাইক ছিনিয়ে নিয়ে তাদের গাড়িতে তুলে নেয়।
তাদের মতে, পুলিশের এই আচরণে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন জামায়াত-শিবির নেতাকর্মী ও স্থানীয় জনতা। ওই সময় পুলিশ নিজেদের রক্ষায় ধুরুং বাজার এলাকার সমাবেশস্থলের কাছে একটি চায়ের দোকান ও কসমেটিকসের দোকানে ঢুকে পড়ে। সেখানে বিক্ষুব্ধ জনতা পুলিশকে লক্ষ করে ইট-পাটকেল ছোড়ে। জবাবে পুলিশ টিয়ারশেল, রাবার বুলেট না ছুড়ে জনতার উদ্দেশে শুরুতেই গুলি চালায়। ‘বৃষ্টির মতো গুলি’র কবল থেকে কোনোমতে বাজারের লোকজন, জামায়াত-শিবির কর্মীরা পালিয়ে রক্ষা পেলেও নিরীহ ৩ বৃদ্ধ ও তরুণ মারা যান।
একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, পরে ওসির নেতৃত্বে অতিরিক্ত পুলিশ এসে আরেক দফায় কয়েকশ’ রাউন্ড গুলিবর্ষণ করে। বিদ্যুিবহীন এলাকা কুতুবদিয়ার ধুরুং বাজারে সমবেত সাধারণ মানুষ ও জামায়াত-শিবির কর্মীরা দিগ্বিদিক ছুটতে শুরু করেন। ওই সময় অনেকেই আহত হন। পুলিশের গুলিতে আহত হন অন্তত ২৫ জনের বেশি মানুষ।
স্থানীয় জামায়াত নেতাদের দাবি, বর্তমানে আহতদের মধ্যে তিনজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তারা চট্টগ্রামের একটি ক্লিনিকে চিকিত্সাধীন রয়েছেন।
অন্যদিকে পুলিশের দাবি, ওই ঘটনায় পুলিশের চার সদস্য আহত হয়েছেন। তারা কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে চিকিত্সাধীন রয়েছেন। এদের মধ্যে একজনের দাঁত ভেঙে গেছে।
তবে নির্বিচারে গুলিবর্ষণকারী রাজিব চাকমা সুস্থ রয়েছেন। তিনি থানাতেই কর্তব্য পালন করছেন।
নিহতরা জামায়াত-শিবিরের সমর্থক : কুতুবদিয়ার জামায়াত নেতা ও স্থানীয়রা জানান, ওই দিনের ঘটনায় নিহত ৩ জনের কেউই জামায়াতে ইসলামী কিংবা ইসলামী ছাত্রশিবিরের কোনো পদবিধারী ব্যক্তি নন, তবে তারা বিএনপি-জামায়াতের সমর্থক।
নিহত ২ জন হলেন মোহাম্মদ আজিজুর রহমান ও মোহাম্মদ ইসমাইল। তাদের মধ্যে একজন লবণ শ্রমিক, অপরজন চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারিতে জাহাজভাঙা শিল্পের একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। ঘটনার দিন তিনজনই ‘সাপ্তাহিক বাজার’ দিন হিসাবে ধুরুং বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য নিতে এসেছিলেন।
নিহতদের পরিবার ও গ্রামবাসী যা বললেন : গত শনিবার সকালে ধুরুং বাজার থেকে মাত্র ৪ কিলোমিটার পূর্বে নিহত বৃদ্ধ আবু বক্কর ছিদ্দিকের বাড়িতে যান সাংবাদিকরা। ওই সময় সাংবাদিকদের আসার খবর পেয়ে এলাকার শত শত মানুষ ওই বাড়িতে সমবেত হন। তারা এলাকার নিরপরাধ বাসিন্দা আবু বক্কর ছিদ্দিককে হত্যার সুবিচার চান।
স্থানীয়রা জানান, একসময় আবু বক্কর ছিদ্দিক ফেরি করে ডিম বিক্রি করতেন। সর্বশেষ যে সময় যে ব্যবসা সুবিধা মনে করেন, সেই ব্যবসা করে তিনি সংসার চালাতেন। আয় উর্পাজনের তেমন বড় ধরনের কিছুই নেই।
ঘূর্ণিঝড়ে প্রথম স্ত্রী মারা যাওয়ার পর দ্বিতীয় স্ত্রী, তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে কোনোমতে ‘পেটে-ভাতে’ চলতেন।
এলাকাবাসী মনে করেন, বৃদ্ধ আবু বক্কর সিদ্দিকের কোনো দলীয় পরিচয় ছিল না, তবে ধানের শীষ অথবা দাঁড়িপাল্লা মার্কা নিয়ে কেউ নির্বাচন করলে তাকে ভোট দিতেন।
নিহত আবু বক্করের স্ত্রী হাজেরা বেগম জানান, ঘটনার দিন মঙ্গলবার ‘সাপ্তাহিক বাজার বার’ ছিল ধুরুং বাজারে। তার স্বামী দুপুরে খাওয়া-দাওয়া শেষে বাজার আনতে ধুরুং বাজারে যান। সুস্থ অবস্থায় বাজারে গেলেও লাশ হয়ে ঘরে ফিরেছেন।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে স্বামী হত্যার সুষ্ঠু বিচার চান তিনি। মায়ের সঙ্গে একই সুরে চোখের পানি ফেলেন তাদের তিন সন্তানও।
আজিজের হত্যার বিচার চান বাবা : নিহত মোহাম্মদ আজিজুর রহমানের বাবা মোহাম্মদ আলমগীর বলেন, ‘আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই, একই সঙ্গে আমার নিরীহ ছেলেকে হত্যার পর কেন কাটা-ছেঁড়া করা হয়েছে তার বিচারও চাই।’
তিনি সাংবাদিকদের কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার ছেলে মারা যাওয়ার পর কাটাছেঁড়া না করার জন্য এসপি, ডিসি, ওসিসহ অনেকের হাতে-পায়ে ধরেছি, কেউ আমার কান্না শোনেনি।’
ছেলের দলীয় পরিচয় সম্পর্কে আলমগীর বলেন, ‘আজিজ প্রকাশ্যে কোনো দল করত না, তবে ছোটকাল থেকেই আল্লামা সাঈদীর ভক্ত ছিল।’
তিনি বলেন, ‘ঘটনার দিন বাজারে গেলে পুলিশ গুলি করে আমার ছেলেকে মেরে ফেলেছে। আমি ছেলে হত্যার সুষ্ঠু বিচার দাবি করছি।’
সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বারবার কান্নায় ভেঙে পড়েন জেলে মোহাম্মদ আলমগীর।
ইসমাইল মাওলানা সাঈদীকে ভালোবাসতেন : নিহত ইসমাইলের বড় ভাই শহিদুল হক জানান, তার ভাই কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল না। চট্টগ্রামের ভাটিয়ারিতে চাকরি করত।
তিনি বলেন, ‘কোরবানির ঈদের ছুটিতে বাড়ি এসে অসুস্থ হয়ে পড়লে সে আর চাকরিস্থলে যায়নি। তবে কয়েকদিনের মধ্যেই চলে যেত।’
ঘটনার দিন হাটবাজারে গেলে পুলিশের গুলিতে সে মারা যায়। তিনিও তার নিরীহ ভাইয়ের হত্যার বিচার চান।
শহিদুল হক বলেন, ‘আমার ভাই কোনো রাজনীতি না করলেও আল্লামা সাঈদীকে ভালোবাসতেন।’
এলাকাবাসীর প্রতিক্রিয়া : নিহত আজিজের শিক্ষক বদিউল আলম কুতুবদিয়া সফরকারী সাংবাদিকদের জানান, নিহত তিনজনই এই এলাকার নিরীহ লোক। কোনো দলের সঙ্গেও তাদের সম্পর্ক নেই।
তিনি জানান, তার খুবই আদরের ছাত্র ছিল আজিজ। ছাত্রজীবন থেকে বেশি সাঈদীভক্ত ছিল সে। প্রায় সময় তার পকেটে সাঈদীর ক্যাসেট থাকত।
তিনি দাবি করেন, ‘আজিজ অনেকবার আমাকে বলেছে, স্যার, সাঈদীর আগে যেন আমার মৃত্যু হয়!’
সৃষ্টিকর্তা আজিজের স্বপ্ন পূরণ করেছেন বলে বিশ্বাস করেন মাস্টার বদিউল আলম।
কুতুবদিয়া উপজেলা জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান শাহরিয়ার চৌধুরী জানান, পুলিশের বাড়াবাড়ির কারণেই কুতুবদিয়ায় এত বড় ঘটনা ঘটেছে।
তিনি বলেন, ‘এলাকাবাসী উত্তেজিত হয়ে পুলিশকে ইট-পাটকেল ছুড়লে পুলিশ টিয়ারশেল, রাবার বুলেট না ছুড়ে শুরুতেই গুলি চালাতে শুরু করে।’
তার দাবি, ‘বৃষ্টির মতো গুলি’র কবল থেকে এলাকাবাসী বাঁচার চেষ্টা করলেও তিনজন বাঁচতে পারেননি।
শাহরিয়ার চৌধুরী আরও দাবি করেন, প্রথম দফা গুলিতে তিনজনের মৃত্যুর পরও পরে ওসির নেতৃত্বে অতিরিক্ত পুলিশ এসে আবারও কয়েকশ’ রাউন্ড গুলি চালিয়েছে।
তিনি জানান, পুলিশের এই এলোপাতাড়ি গুলিতে ৫০ জনেরও বেশি মানুষ আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৩ জন এখনো শঙ্কামুক্ত নন। তারা চট্টগ্রামে চিকিত্সাধীন রয়েছেন। জীবন নিয়ে শঙ্কায় আছেন তাজুল ইসলাম ও মোহাম্মদ নোমান।
কুতুবদিয়া থানার ওসি যা বললেন : জেলার বিচ্ছিন্ন দ্বীপ কুতুবদিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জহিরুল ইসলাম খান বলেন, স্থানীয় লোকজনের কবল থেকে বাঁচতে পুলিশ টিয়ারশেল ও রাবার বুলেট ছুঁড়েছে। তবুও জনতা পিছু না হটলে পুলিশ গুলি চালিয়ে নিজেদের বাঁচার পথ খুঁজে নিয়েছে।
ওসি জহিরুল জানান, সেই ঘটনায় পুলিশের চার সদস্যও আহত হয়েছেন। ডিউটিরত পুলিশ মারফতে খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছলে জনতা পুলিশের উদ্দেশে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে।
তিনি বলেন, ‘আমার পুলিশ সদস্য রাজিব গুলি না করলে এই চেয়ারে (ওসি পদে) বসা সম্ভব হতো না! এমনকি এখন জনতার লাশ দেখতে পেয়েছি, তখন আমার পুলিশ ভাইদের লাশ দেখতে হতো।’
ওসি জহিরুল ইসলাম সোত্সাহে বলেন, ‘রাজিব একাই ৫০ রাউন্ড গুলি করে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে।’
এখন পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে বলেও জানান তিনি।


Viewing all articles
Browse latest Browse all 358

Trending Articles